পবিত্র মেরাজের রাতে বিশ্বনবী (স.) স্বচক্ষে বেহেশত-দোজখ দেখেছেন। সাক্ষাৎ করেছেন পূর্ববর্তী নবী-রসুলদের সঙ্গে। সুবিশাল নভোমণ্ডল পরিভ্রমণ, আরশ-কুরসি প্রভৃতি সামনাসামনি সশরীরে দেখা, সর্বোপরি মহান রবের সঙ্গে পবিত্র দিদার লাভ করাসহ অবলোকন করেছেন সৃষ্টিজগতের অপার রহস্য। নামাজের বিধান রচিত হয় এ রাতেই।
এই পবিত্র ভ্রমণে প্রিয়নবী (স.) অনেক পাপের শাস্তি প্রত্যক্ষ করেছেন।
পরনিন্দাকারী
‘তিনি জাহান্নামে একদল লোক দেখলেন, যারা তামার তৈরি নখ দিয়ে অনবরত নিজেদের মুখমণ্ডল ও বুকে আঁচড় মারছে। জিব্রাইল (আ.) বললেন, এরা মানুষের গোশত খেতো (গিবত ও পরনিন্দা করত)। (আবু দাউদ: ৪৮৭৮, মুসনাদে আহমদ: ৩/২২৪, তাফসিরে ইবনে কাসির: ৫/৯)
আমলহীন বক্তা
রাসুলুল্লাহ (স.) এমন কিছুসংখ্যক লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, যাদের জিব ও ঠোঁট আগুনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। জিব্রাইল (আ.) বলেন, এরা আপনার উম্মতের স্বার্থপূজারি উপদেশদাতা, যারা অন্যকে সৎ কাজের নির্দেশ দিত, কিন্তু নিজের খবর রাখত না। (মাআরেফুল কোরআন: ৩৭, মুসনাদে আহমদ: ১২২১১)
নামাজে অলস
অতঃপর এমন এক সম্প্রদায়কে দেখলেন, পাথর দিয়ে যাদের মাথা চূর্ণবিচূর্ণ করা হচ্ছে। জিব্রাইল (আ.) বলেন, তারা নামাজে অলসতা করত। (ফাতহুল বারি: ৭/২০০)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, "রাসুল (সা.) তাঁর সফরসঙ্গী ফেরেশতাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী অপরাধে তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে? উত্তরে বললেন, এ ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করেছিল। কিন্তু কুরআন অনুযায়ী আমল করেনি এবং সে ফরজ সালাতের সময় ঘুমিয়ে থাকত। কেয়ামত পর্যন্ত তাকে এভাবে শাস্তি দেওয়া হবে।" (সহিহ বুখারি: ৭০৪৭)
সুদখোর
তিনি (স.) সুদখোরের যে শাস্তি দেখেছেন, তা সামুরা বিন জুনদুব (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে— “আমরা একটি রক্তের নদীর কাছে আসলাম। দেখলাম, নদীতে এক লোক সাঁতার কাটছে। নদীর তীরে অন্য এক লোক কতগুলো পাথর একত্র করে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সাঁতার কাটতে কাটতে লোকটি যখন নদীর কিনারায় পাথরের কাছে দাড়ানো ব্যক্তির কাছে আসে, তখন দাড়ানো ব্যক্তি তার মুখে একটি পাথর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। পাথর মুখে নিয়ে লোকটি আবারো সাঁতরাতে শুরু করে। যখনই লোকটি নদীর তীরে আসতে চায়, তখনই তার মুখে পাথর ঢুকিয়ে দেয়া হয়। রাসুল (স.) কারণ জানতে চাইলে ফেরেশতাদ্বয় বললেন, এরা হলো আপনার উম্মতের সুদখোর”। (সহিহ বুখারি, মাশা হা/৬৬৪০)
অন্য বর্ণনায় আছে, শবে মেরাজে নবীজি এমন লোকদের দেখলেন, যাদের পেট ছিল একেকটি গৃহের মতো। পেটের ভেতরটা সাপে ভর্তি, যা বাইরে থেকেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। প্রশ্ন করা হলে জিব্রাইল জানালেন, এরা সুদখোর। (আহমদ: ২/৩৫৩)
এতিমের সম্পদ আত্মসাৎকারী
যারা এতিমের মাল আত্মসাৎ করে, তাদের ঠোঁটের আকৃতি ছিল উটের ঠোঁটের মতো। তারা পাথরের টুকরোর মতো আগুনের ফুলকি মুখের মধ্যে পুরছিল এবং সেগুলো পায়খানার রাস্তা দিয়ে বের হচ্ছিল।
ব্যভিচারী নারী-পুরুষের শাস্তি
এ প্রসঙ্গে বর্ণনা দিতে গিয়ে রাসুল (স.) ইরশাদ করেন—
“আমরা একটি তন্দুর চুলার কাছে আসলাম। যার উপরিভাগ ছিল সংকীর্ণ এবং ভেতরের অংশ ছিল প্রশস্ত। তার ভেতরে আমরা কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। দেখতে পেলাম, তাতে রয়েছে কতগুলো উলঙ্গ নারী-পুরুষ। তাদের নিচের দিক থেকে আগুনের শিখা প্রজ্বলিত করা হচ্ছে। অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা উচ্চৈঃসরে চিৎকার করছে।
রাসুল (স.) কারণ জানতে চাইলে ফেরেশতাদ্বয় বললেন, এরা হলো আপনার উম্মতের ব্যভিচারী নারী-পুরুষ”। (বুখারি)
অন্য বর্ণনায় আছে, নবী (স.) মেরাজের রাতে একদল লোকের কাছে উপস্থিত হয়ে দেখলেন, তাদের সামনে একটি পাত্রে গোশত রান্না করে রাখা হয়েছে। অদূরেই অন্য এক পাত্রে রয়েছে পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত কাঁচা গোশত। লোকদেরকে রান্না করে রাখা গোশত থেকে বিরত রেখে পঁচা ও দুর্গন্ধযুক্ত, কাঁচা গোশত খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। তারা চিৎকার করছে এবং একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা থেকে ভক্ষণ করছে। নবী (স.) জিব্রাইল ফেরেশতাকে জিজ্ঞেস করলেন, এরা কোন শ্রেণির লোক? জিব্রাইল (আ.) বললেন, এরা আপনার উম্মতের ওই সমস্ত পুরুষ, যারা নিজেদের ঘরে পবিত্র এবং হালাল স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অপবিত্র ও খারাপ মহিলাদের সঙ্গে রাত্রি যাপন করত। (আল-খুতাবুল মিম্বারিয়াহ, ড. সালেহ ফাওযান)
মিথ্যুক ও গুজব রটানোর শাস্তি
মেরাজের রাতে নবীজির দেখা মিথ্যুকের শাস্তি বর্ণনায় হজরত সামুরা বিন জুন্দুব (রা.) হতে বর্ণিত রাসুল (স.)-এর দীর্ঘ হাদিসে বলা হয়েছে—
“অতঃপর আমরা এমন এক লোকের কাছে উপস্থিত হলাম, যাকে চিৎ করে শায়িত রাখা হয়েছে। একজন লোক লোহার বড়শি হাতে নিয়ে তার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়ানো ব্যক্তি শায়িত ব্যক্তির মুখের একদিকে লৌহাস্ত্র প্রবেশ করিয়ে পিছনের দিকে ঘাড় পর্যন্ত চিড়ে ফেলছে। নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করিয়ে অনুরূপ করা হচ্ছে এবং চোখের ভেতর প্রবেশ করিয়েও অনুরূপ করা হচ্ছে। একদিকে চিড়ে শেষ করে অন্যদিকেও অনুরূপ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় দিকে চিড়ে শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম দিক আগের মতো হয়ে যাচ্ছে। আবার প্রথম দিকে নতুন করে চেড়া হচ্ছে। হাদিসের শেষাংশে এসেছে, রাসুল (স.) জিজ্ঞেস করলেন, কী অপরাধের কারণে তাকে এভাবে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে? জিব্রাইল (আ.) বললেন, এ এমন লোক, যে সকাল বেলা ঘর থেকে বের হয়েই মিথ্যা কথা বলত এবং সে মিথ্যা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ত।” (বুখারি)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সব ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দিন। আল্লাহর আদেশ ও তাঁর রাসুল (স.)-এর আদর্শমতো জীবন গঠনের তাওফিক দান করুন। আমিন।